১৯ জুলাই ঢাকার রাজপথে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে পুলিশের গুলি—সেদিন ছিল ভয়াবহ। সেই ভয়াল দিনেই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন যশোরের তরুণ ছাত্র ইমন কবির।
গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রায় এক বছর ধরে লোহা দিয়ে বাঁধা একটি যন্ত্র পায়ে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে। তার জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ থমকে গেছে, কিন্তু থেমে যাননি তিনি।
সেদিন জুমার নামাজ পড়ে আফতাবনগর গেটের সামনে এসে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের নির্বিচার গুলি ছোড়ার দৃশ্য নিজ চোখে দেখেন ইমন। আহতদের সাহায্যে এগিয়ে গেলে নিজেই গুলির শিকার হন। গুলি লাগে ডান পায়ের টাকনুর ওপর। হাড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। চিকিৎসায় তার পায়ে লোহার তৈরি একটি যন্ত্র স্থাপন করা হয়, যা এখনও খুলে ফেলা যায়নি।
ইমনের বাড়ি যশোর শহরের ষষ্টিতলায়। পিটিআই সড়কের একটি টিনশেড বাড়িতে বাবা-মা ও নানির সঙ্গে থাকেন। বাবা হুমায়ুন কবির একজন দর্জি, মা স্বপ্না কবির গৃহিণী। যশোর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে পলিটেকনিকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন ইমন। গাজীপুরের একটি কোম্পানিতে ইন্টার্ন করতে গিয়ে ঢাকায় থাকতেন এবং রাইড শেয়ার করে পড়ালেখার খরচ চালাতেন।
আহত অবস্থায়ও ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন ইমন। এখন শুধু রিটেক বাকি। সেই পরীক্ষা মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) অনুষ্ঠিত হবে। তাঁর চোখে-মুখে রয়েছে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা—কবে পায়ের যন্ত্র খুলবে, আদৌ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কি না, তা নিয়ে তিনি শঙ্কিত।
চিকিৎসা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ইমন ও তার মা বলেন, চিকিৎসকেরা এখন পর্যন্ত কোনো স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেননি। বিদেশে চিকিৎসা করাতে পারলে হয়তো দ্রুত সুস্থ হওয়া যেত।
রাজপথে আহত হওয়ার পর নাগরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ইমনকে। পরে ভর্তি হন পঙ্গু হাসপাতালে। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরেন, আবার কয়েক দফায় ভর্তি হন। ঈদের পর ভর্তি হতে গেলে পুলিশ বাধা দেয় বলেও অভিযোগ করেন তিনি। ভর্তি হলেও সেখানে পরিবেশ ছিল অমানবিক, তাই দুই দিন পরেই ফিরতে হয়।
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় নেতা অনিন্দ্য ইসলাম অমিত এবং জামায়াত নেতা রুহুল কুদ্দুস ইমনকে আর্থিক সহায়তা দেন। পরীক্ষা দিতে যেন কোনো সমস্যা না হয়, সে জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগও করেন তারা।
ইমন বলেন, “গুলির সময় আমি আহতদের সাহায্য করছিলাম, সেজন্যই আমাকে টার্গেট করে গুলি চালানো হয়।”
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইমন বলেন, “নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে ফ্যাসিবাদকে ফিরিয়ে আনার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। যদি তারা আবার আসে, তাহলে আমাদের মতো জুলাই যোদ্ধারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিছু নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, “এগুলোর জন্য কেউ আন্দোলন করেনি। এটি বন্ধ না হলে মানুষ আন্দোলনের প্রতি আস্থা হারাবে।”
ইমন মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে অনেক ভুল রয়েছে। সচিবদের প্রভাব নিয়েও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। “সরকার যেন সচিবরাই চালাচ্ছেন। তাদের সরাতে না পারলে কিছুই পরিবর্তন হবে না।”
তার দাবি—জুলাই সনদ ঘোষণা করা হোক, নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হোক এবং সুশাসনের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হোক।