রাজধানীর চকবাজারের মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রকাশ্য দিবালোকে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে পিটিয়ে ও ইট-পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে চরম প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে।
বুধবার (৯ জুলাই) বিকেলে সংঘটিত এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে জাতীয় নিরাপত্তা, শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে একযোগে প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজ।
ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক সংযোগ
নিহত সোহাগ এক সময় বিএনপির অঙ্গসংগঠন যুবদলের কর্মী ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত পাঁচ অভিযুক্তও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইতোমধ্যে র্যাব ও পুলিশ অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। র্যাব জানিয়েছে, ঘটনাটি চাঁদাবাজির নয়, বরং ব্যবসায়িক বিরোধ থেকে ঘটেছে।
তবে ভিডিও প্রকাশের পর যে জঘন্য বাস্তবতা সামনে এসেছে, তা কেন্দ্রীয় রাজনীতিকেও নড়বড়ে করে তুলেছে। সরকারপক্ষ মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
বহিষ্কার ও বিবৃতি, কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়
ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিএনপি যুবদলের পাঁচ সদস্যকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে। একই সঙ্গে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেন, “এই পৈশাচিক ঘটনা কেবল একটি জীবনহানিই নয়, এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় চরম ব্যর্থতার প্রতিফলন।”
তারেক রহমানও গুলশানে ছাত্রদলের এক অনুষ্ঠানে বলেন, “অপরাধী যে-ই হোক, তার বিচার হতেই হবে। বিএনপি কখনো অপরাধীদের রক্ষা করে না।” একইসঙ্গে তিনি ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা প্রকাশ করে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান।
নেতৃত্বের দুর্বলতা ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ, আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে নির্বাসিত। নেতৃত্বের এই শূন্যতায় স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণহীন আচরণ ও দলীয় শৃঙ্খলা ভাঙার ঘটনা বারবার আলোচনায় এসেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির কেন্দ্র-তৃণমূলের সংযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাতারভিত্তিক সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের মন্তব্য করেন, “আগা ও গোড়ায় টক্সিন রেখে শুধুমাত্র বহিষ্কার খেলাটা মকারী ছাড়া কিছু নয়। বিএনপিকে টপ-টু-বটম ঢেলে সাজাতে হবে।”
রাজনৈতিক কৌশল নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিভ্রান্তি?
এই হত্যাকাণ্ড ঘিরে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক—বিএনপিকে কোণঠাসা করতে এবং জাতীয় নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময়ে তাদের নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই কি এটি ব্যবহার হচ্ছে? শুক্রবার (১১ জুলাই) রাতেই ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ নামে মিছিল বের হয়, যেখানে তারেক রহমানকে লক্ষ্য করে অশালীন ভাষায় স্লোগান দেওয়া হয়।
এই স্লোগান নিয়ে বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সাংবাদিক আনিস আলমগীর বলেন, “যে নেতা দেশে নেই, ক্ষমতায় নেই, তাকে এভাবে দায়ী করা রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির ইঙ্গিত দেয়। তারেক রহমান যদি সত্যিই দেশে আসতেন, তাহলে পরিস্থিতি হয়তো ভিন্ন হতো। বরং এখন তাকে ফেরত আসা থেকে বিরত রাখতেই এসব করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।”
পুলিশি ভূমিকা ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ
যুবদল সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না অভিযোগ করেছেন, “সিসিটিভি ফুটেজে যাদের দেখা গেছে, তাদের বাদ দিয়ে তিনজন নিরপরাধকে আসামি করা হয়েছে।” তিনি ঘটনার দিন (বুধবার) থেকে ভিডিও ভাইরাল হওয়া (শুক্রবার) পর্যন্ত দুই দিনের ব্যবধান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা সারজিস আলম তারেক রহমানকে উদ্দেশ্য করে ফেসবুকে লেখেন, “যেভাবে আওয়ামী লীগের অপরাধের দায় শেখ হাসিনার হয়, বিএনপির ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।”
অবনত রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও অশুভ ইঙ্গিত
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সংস্কৃতি, ফ্যাসিবাদী চর্চা এবং নেতৃত্বের অনুপস্থিতির ফলে দেশে আবারও ভয়াবহ সহিংসতার পথে যাত্রা শুরু হয়েছে। এক বছর আগে ঘটে যাওয়া জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর যে নতুন রাষ্ট্রিক ধারা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তা এই ধরনের ঘটনা ও প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ভেস্তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আনিস আলমগীর বলেন, “জামায়াত-শিবির, এনসিপি, ছাত্রদল, যুবদল—সবাই মিলেই ৫ আগস্টের পর মব কালচার চালু করেছে। এখন সেই ধারাবাহিকতাতেই মিটফোর্ডে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল। প্রশাসন, পুলিশ, সেনা, র্যাব কেউ কিছু করলো না। এ কি শুধুই ব্যর্থতা, না কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নীরবতা?”
উপসংহার
মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ড একটি বর্বর অপরাধ মাত্রই নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এক জ্বলন্ত প্রতিফলন। অপরাধের দায় কার, বিচার কীভাবে হবে, এবং এর পেছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আছে কি না—এই প্রশ্নগুলোর জবাব সময়ই দেবে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দায় এড়ানোর কৌশল, অপপ্রচার এবং প্রতিহিংসার চর্চা চলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই ধরনের নৃশংসতা বন্ধ হবে না।